নেতৃত্ব, কেভিন রাড ও বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা

সি ড নি থে কে
অজয় দাশগুপ্ত
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাডকে সৌম্য দর্শন বলা যেতেই পারে। এক জীবনে তিন-তিনটি রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারাটা সৌভাগ্যের না দুর্ভাগ্যের জানি না, তবে নিয়তি সেটাই করে দেখিয়েছে। আমি জন্মেছি পাকিস্তানে, কৈশোরে পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব আর জীবনযুদ্ধে প্রবাসে পাড়ি দিয়ে পেলাম অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকত্ব।
প্রবাসে দেশত্যাগী মানুষের স্বদেশ প্রেম থাকে তুঙ্গে। অদর্শনে যেকোনো ভালোবাসা হয় গভীর; নাড়ীর টান হলে তো কথাই নেই। তাই বলে পানিতে বসবাস করে তার অস্তিত্ব অস্বীকারকে কি কৃতজ্ঞতা বলা যাবে? বাঙালির এক অংশের মধ্যে এর অভাব প্রকট। বৈপরীত্যটা কোথায় দেখুন, নিশিদিন দেশ ও দেশজ চিন্তায় ডুবে থাকেন বটে, ঢাকা-চট্টগ্রাম গেলে দু হপ্তা পরই টিকিটের তারিখ এগিয়ে আনতে ছোটেন; যানজট, ধুলাবালি, শব্দদুষণে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। হরতাল-ধর্মঘট থাকলে নেতা-নেত্রীদের তুলোধুনো করে ছাড়েন, অথচ এই ভাইজানই হয়তো সিডনি আওয়ামী লীগের বড় কর্তা অথবা বিএনপিপ্রধান, ইনিই গাঁটের পয়সা খরচ করে দুতাবাসের সামনে মানববন্ধন করেন, এঁদের প্ল্যাকার্ড, পোস্টার আর সমাবেশপ্রীতিতে মনে হবে এ যেন ঢাকা বা দেশেরই অন্য কোনো বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। বড় দল বলে পরিচিত দুটো দলের সর্বগ্রাসী রাজনীতি এভাবেই গ্রাস করেছে আমাদের। দেশের পাশে, জনগণের মঙ্গলে দাঁড়ানোর চেষ্টা নেই, নেই প্রগতিশীল রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজ প্রক্রিয়া আত্মস্থ করার ব্যাকুলতা। উল্টো রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে এদের সার্বক্ষণিক অসত্য ও মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়, যা এসব দেশের জীবনব্যবস্থার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।
অস্ট্রেলিয়ানরা জীবনে কোনো ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি করে না। গালাগাল দিলেও তা এতটা নিঃশব্দে আর সৌজন্যে যে তা কারও কর্ণগোচর হওয়ার নয়। আমরা তার উল্টোটি। হাতে-পায়ে ধরে, ধরনা দিয়ে, পরীক্ষা দিয়ে, টেস্টের পর টেস্টে উত্তীর্ণ হয়ে এদের দেশে ঢুকেই বিপরীত চেহারা ধারণ করি। খাই-দাই, রোজগার করি, অর্জিত অর্থে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই সন্তান-সন্ততীদের লালন করি তবুও আপন ভাবতে পারি না। যে যা-ই বলুক, একে উগ্র দেশপ্রেম বা স্বদেশ চেতনা বলাটা অন্যায়। তা ছাড়া এর পেছনে দেশপ্রেম কতটা তাও নিরীক্ষার বিষয়। দুগ্ধঘৃত, ননী, মাখন, খাঁটি বা ভেজালহীন খাদ্য, বায়ুদুষণহীন আকাশ, যানজটহীন পথঘাট, সচ্ছল-নির্মল জীবনব্যবস্থা ফেলে যাবেন না জেনেও এসব দেশ জাতির পক্ষাবলম্বন করতে না পারার মূল কারণ অন্যত্র।

সেটা মূলত রাজনীতি। কোন রাজনীতি?
যা ৩০ বছর ধরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে−যেসব দলের আদৌ কোনো অর্থনৈতিক এজেন্ডা নেই, যেসব নেতা-নেত্রীরা তাঁদের আচরণের মতোই অপরিশীলিত, অগণতান্ত্রিক, তাঁদের জন্য প্রবাসেও শান্তি বিপন্ন।

তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠার আগে সমর্থকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, আমরা গণতান্ত্রিক দেশে ম্যাককেইন-ওবামা, জন হাওয়ার্ড ও কেভিন রাডের গণতান্ত্রিক বাদানুবাদে প্রলুব্ধ হই, স্বদেশীয় নেত্রীদের জন্য তা চাই না, বড়ই আফসোস। অগ্রজ বুদ্ধিজীবী দেশবরেণ্য অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও আজ দিগ্ভ্রান্ত। কালের সাক্ষীদের কলমও একদর্শী।

প্রবাসী এক লেখককে বলেছিলাম, কেন নতুন প্রজন্ন আমাদের মতো বয়স্ক মানুষের চোখে পৃথিবী দেখবে?
কেন তার বিবেক ও চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে অশীতিপর মানুষের অতীত অথবা স্মৃতিকারতা? উত্তর মেলেনি।


অভিজ্ঞতা বা বয়সী প্রেরণার কথা ভিন্ন, শক্তি ও সাহস জোগাতে পারলে নেলসন মান্ডেলার মতোই মানুষটি হবেন চির তরুণ, কিন্তু বিদেশে বসে ভগ্নির ‘কাইজা’ বা যুবরাজের চিকিৎসার বিবরণে কি তার কোনো ছায়া মেলে?

দেখেশুনে মনে হয়, দুই দল আর দলের ডালপালা গ্রামের বুড়ো অশ্বত্থ গাছটির মতো− অজানা ভয়, দৈবদুর্বিপাক, অমঙ্গলের আশঙ্কায় সাধারণ মানুষ এর তলায় বাতি জ্বালায়, খই-মুড়ি প্রসাদ ছড়িয়ে দেয়, কেউ মানত রেখে চুল কাটে অথবা সালাম ঠোকে। কিন্তু একবার যদি ভুল ভাঙে এবং বুঝতে পারে যে এর ক্ষমতা সীমিত, অমঙ্গল করার শক্তি নেই, তাহলে এর কাঠে রন্ধনকার্য চালাতে এক মুহুর্তও বিলম্ব করবে না।

এটাই তফাত। ভালোবাসলে বা শ্রদ্ধা করলে বাতি জ্বালাত না, কেটেও নিত না, বলছিলাম নেতৃত্বের কথা।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড কেবল সুদর্শনই নয়, তাঁর বক্তব্য, কথা বলার ভঙ্গি, পোশাক-আচরণ−সবকিছু জুড়েই ভদ্রতা আর বিনয়ের ছাপ।

সবচেয়ে বড় কথা দায়িত্বশীল আর অভিভাবকতুল্য মনোযোগ, সারা বিশ্বে অর্থনীতির ঘোর দুর্দিন, চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এখন ভেঙে পড়ছে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, তখন এক পা বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার পুরো এক শতাংশ কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী পাশে দাঁড়িয়ে, মজবুত ও দৃঢ় ভিত্তিতে থাকার পরও অস্ট্রেলিয়ার এই ঘোষণা, আগাম সতর্কতা ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষা। অর্থমন্ত্রী একাই তা পারতেন, প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিয়েছেন ভয়ের কিছু নেই, দুর্ভাগ্য এঁদের, এর পরও এঁদের জন্য কেউ মিছিল করে না, মিটিং নেই, নেই জিন্দাবাদও।
আর আমরা যাঁদের জন্য জান দিই, রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও করি, ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলি, তাঁরা কি কিছু বলেছেন! এ পর্যন্ত তাঁরা কেউই জানান দেননি দরিদ্র দেশটি কীভাবে এ দুর্যোগ বা ঝড় সামলাবে। আদৌ তাঁরা বিষয়টি বোঝেন কি না, কে জানে? কিন্তু জাতিকে তো বুঝতে হবে, আর সে জন্যই চাই আধুনিক ও শিক্ষিত নেতৃত্ব। নইলে বেড়ালের ঘণ্টাটি চিরদিনই বন্ধনহীন থেকে যাবে।
অজয় দাশগুপ্ত: সিডনিপ্রবাসী লেখক।
dasguptaajoy@hotmal.com
সূত্রঃ প্রথম আলো, ২৫ অক্টোবর, ২০০৮

0 comments:

Post a Comment